History

সুলতান তুঘরুল বেগ

সুলতান তুঘরুল বেগের জীবনী

সেলজুকদের পরিচয়ঃ- দশম শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া এবং রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব এলাকা হতে একশ্রেণীর যাযাবর লোকের আবির্ভাব হয়। তাদের মধ্যে একটি গোত্র ছিল, যাদের নেতার নাম সেলজুক। তাদের নেতার নাম অনুসারেই তারা সেলজুক নামে পরিচিত হয়। এ গোত্রটি পরবর্তীতে সুন্নি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তারা সামানি সাম্রাজ্য এবং গজনি সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একসময় তারা নিজেরা গজনি সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেয়। সেলজুকের দুই নাতি চাগরি বেগ ও তুঘরিল বেগ নিজেদের অধীনে পারসিকদের অঞ্চলে খণ্ড সাম্রাজ্য কায়েম করে। চাগরি খোরাসান এলাকা দখলে নেয় এবং তুঘরিল নেয় পশ্চিম ইরান এবং মেসোপটেমীয় এলাকা।

 তুঘরুল বেগের জন্ম: তুঘরিল বেগ, পূর্ণ নাম: সুলতান রুকনুদ্দিন আবু তালিব তুঘরুল-বেগ মুহাম্মদ ইবনে মিকাইল ইবনে সেলজুক। তুঘরুল আল্প, তুগ্রিল, তওগ্রিল, তুগরুল বা টোগ্রিল বেগ। (তুর্কি: তুগ্রুল)। তিনি সেলজুক সাম্রাজ্য এর তুর্কি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং ১০৩৭ থেকে ১০৬৩ পর্যন্ত সাম্রাজ্যটি শাসন করেন। তুঘরিল বেগ ৯৯০ সালে সেলজুকের পুত্র মিকাইল বেগ ইবনে সেলজুকের ঘরে জন্ম গ্রহণ করে। তুঘরিল ছিলেন মিকাইল বেগ ইবনে সেলজুক এর পুত্র। বালক বয়সেই তার পিতা মিকাইল বেগ ইবনে সেলজুক মারা যায়। বাবার মৃত্যুর পরে তুঘ্রিল ও তার ভাই চাঘরি তাদের পিতামহ সেলজুক এর নিকট লালিত-পালিত হন। তুঘরুল বেগের  স্ত্রী ছিলেন ইউসুফ কাদির-খানের কন্যা আলতুনজান খাতুন। সুলতানের কোনো সন্তানাদী ছিলনা।

সুলতান হওয়ার ইতিকথা : সেলজুকরা প্রথমে কারা-খানিদ শাসক আলী-তেগিনের অধিনে আনুগত্য স্বীকার করে বসবাস করতে থাকে,পরবর্তীতে তার মৃত্যুর পরে সেলজুকরা খোয়াজরমের শাসক হারুনের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। এরপরে সেলজুকরা সেই জায়গায় গিয়েছিল যেখানে তুঘরুল বেগের চাচা আরসালান গিয়েছিল এবং মাহমুদের পুত্র, মাসউদ (প্রথম) এর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে।  

তবে মাসউদ যাযাবর তুর্কিদেরকে একটি বিপজ্জনক হুমকি হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন এবং সেনাপতি-ইন-চিফ বেগতোগদির অধীনে একটি সেনাদল প্রেরণ করেছিলেন। তুঘরুল বেগের সেলজুক বাহিনী সুলতান মাসুদ প্রথম এর বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে, এর ফলে সেলজুকরা ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তা দেওয়ার শর্তে মাসুদের কাছ থেকে নাসা, ফারাভা এবং দিহিস্তানের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে সেলজুকরা তুঘরুল বেগের অধিনে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।

১০৩৭ সালে, সেলজুকরা গজনভিদের সরখ, অ্যাবিভার্ড এবং মারউ অবরোধ করে।  এরপরে সেলজুকরা ধীরে ধীরে খোরাসানের শহরগুলিকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে অভিযান শুরু করে। তুঘরুল বেগ নিশাপুর দখল করে নেন এবং গজনভী সাম্রাজ্য থেকে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে। 

পরবর্তীতে তুঘরুল বেগ সুলতান রুপে আত্মাপ্রকাশ করেন। তুঘরিল বেগের নেতৃত্বে সেলজুকরা বাগদাদে বুওয়িদদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে সুন্নি ইসলামের অধীনে পুরো মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করতে ভূমিকা রাখে। বাগদাদ জয়ের পর তুঘরুল বেগ বাগদাদের তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা কায়্যিমের কন্যাকে বিয়ে করার জন্য খলিফার দরবারে বিবাহ-প্রস্তাব পাঠান। খলিফা কায়্যিম তাতে সম্মতি দেন এবং তুঘরিল বেগকে রুকুনুদ্দীন উপাধি প্রদান করেন। বিয়ের মাত্র ছ’মাস পর তুঘরিল বেগ মৃত্যুবরণ করেন। তখন সাম্রাজ্যের জন্য তার কোনো পুত্রসন্তান উত্তরাধিকারী না থাকায় দায়িত্ব বর্তায় তার ভাতিজা আল্প আরসালানের কাঁধে। আল্প আরসালান ছিলেন তুঘরুল বেগের ভাই চাগরি বেগের পুত্র। 

তুঘরুল বেগের ব্যাক্তিত্ব: সুলতান তুঘরুল বেগ একজন ব্যক্তিত্ত্বশালী , অসাধারণ মেধাবী এবং সাহসী একজন সমর নায়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দ্বীনদার এবং আবেদ। আর এই কারণেই তিনি তার জাতীর কাছ থেকে অনেক বড় সমর্থন এবং সাহায্য পেয়েছিলেন। তিনি ‘’সুলজুকি তুর্ক’’ নামক শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং ‘’শক্তিশালী রাষ্ট্র’’ এই শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে যান। তিনি তার খিলাফতের(সাম্রাজ্য) সীমানা সম্প্রসারণ করে দক্ষ কূটনৈতির মাধ্যমে পৃথিবীর অর্ধ-ভূখণ্ড তার শাসন বলয়ের মধ্য রাখতে সক্ষম হন।

সুলতানের ভাই চাগরি বেগ : চাগরি এবং তার ভাই তুঘরুল ছিল মিকাইল বেগের সন্তান এবং সেলজুক বেগ এর নাতি। এই মহান সেলজুক সাম্রাজ্য পরে তার নামে নামকরণ করা হয়। যারা ছিল একটি আধুনিক তুর্কি বংশীয় নেতা বা ওর্গুজ-উপজাতি। প্রথম জীবনে মিকাইল বেগ এর পুত্র তুঘরুল বেগ ও চাগরি বেগ এর অধীনে সেলজুকরা খোরাসানে স্থানান্তরিত হয়। এবং ১০৪০ খ্রীস্টাব্দের ২৩ ই মে  দণ্ডানাকানের যুদ্ধে অভিযান চালায়। এতে সেলজুকরা জয় লাভ করেন। 

ফলে বিজয়ী সেলজুকরা খোরাসানের মালিক হন তাদের ক্ষমতা ট্রান্সক্সিয়া এবং ইরান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ১০৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তুঘরুল বেগ বাগদাদ পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণকে বিস্তৃত করেছিলেন এবং নিজেকে আব্বাসীয় খলিফার রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আব্বাসীয় খলিফা তাকে সুলতান উপাধিতে সম্মানিত করেছিলেন। চাগরি বেগ তার ভাইয়ের এই সব দুর্ধর্ষ অভিযানগুলোর সেকন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন। তিনি ১০৪০-১০৬০) খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত খোরাসানের প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। ১০২৫ সালের পূর্বে চাগরি ও তুগ্রিলের জীবন সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা যায়। 

উভয়ই তাদের পিতামহ সেলজুকের কাছে রণকৌশল রপ্ত করে। তাদের বয়স যখন ১৫ বছর ছিলো তখন গাজনীর সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে আলী টিগিন বুঘরা খান নামে এক সেনাপতির সাথে তাদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়েছিলেন। পূর্ব আনাতোলিয়াতে তার অভিযান তার দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। গজনীদের সাথে এটি যদিও তার প্রথম অভিযান ছিলো। গজনীদের সাথে তুমুল সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং তাদের পরাজিত করেন। গজনীদের পরাজিত করার পর জেন্ড থেকে আনাতুলিয়ায় ফিরে আসেন। এবং বাইজেন্টাইনদের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি পূর্ব আনাতোলিয়ার মধ্যে বাইজেন্টাইন দুর্গ আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তবে, ক্লড ক্যাহের মতে এটি অত্যন্ত অসম্ভব এবং দুর্দর্শী অভিযান ছিল। ১০৩৫ থেকে ১০৩৭ পর্যন্ত চাগরি ও তুঘরুল মারভে (বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক শহর) ছিলেন। 

চাগরী বেগ গজনীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন এবং দন্ডকানের যুদ্ধে একটি বড় সংঘর্ষের সূচনা করে। তুঘরুল দ্বিধাবোধ করতেন এবং হিট-এন্ড রান অ্যাটাককে অব্যাহত রাখতে পছন্দ করতেন কিন্তু চাগরি সেলজুক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সরাসরি বিরোধের সম্মুখীন করেছিলেন।  দণ্ডনকানের যুদ্ধে সেলজুকরা সাংখ্যিকভাবে উচ্চতর গজনী বাহিনীকে পরাজিত করে। 

যুদ্ধের পরে একটি কুরালতাই অনুষ্ঠিত হয় যার দ্বারা দুই ভাইয়ের মধ্যে সাম্রাজ্য বিভাজিত হয়। তুঘরিল পশ্চিমে (আধুনিক পশ্চিম ইরান, আজারবাইজান ও ইরাক) শাসন করে, চেগরি পূর্ব ইরান, তুর্কমেনিস্তান এবং আফগানিস্তানে রাজত্ব করেছিলেন যা সমৃদ্ধভাবে বৃহত্তর খোরসান নামে পরিচিত একটি অঞ্চল। চাগরী পরে বলখ (আধুনিক উত্তর আফগানিস্তানে) দখল করেন। ১০৪৮ সালে তিনি দক্ষিণ ইরান এবং ১০৫৬ সালে সিস্তান (দক্ষিণ-পূর্ব ইরান) অঞ্চলের  মধ্যে কর্মেন জয় করেন। সেলজুকরা পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফতের উপর অধিক প্রভাব বিস্তার লাভ করে।

 অবদান সমূহ : সেলজুকদের নেতা তুঘরুল বেগ ইসলামী বিশ্বকে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় সফল হন। তিনি  বুভেয়হীদের রাষ্ট্রকে ৪৪৭ হিজরী সালে উচ্ছেদ করে এই অঞ্চল থেকে ফিতনা দূরীভূত করতে সক্ষম হন। যারা মসজিদের দরজায় সাহাবীদেরকে গালী দিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখা টাঙাত তাদেরকে তিনি সমূলে উৎখাত করতে সক্ষম হন। এই ব্যাপারে সব চেয়ে বেশি সীমা লঙ্ঘন কারী রাফেজি আবু আব্দুল্লাহ আল জালাবিবককে তিনি হত্যা করেন। 

বাগদাদের আব্বাসী খলিফার উপর এই বুভেয়হীদের প্রচণ্ড চাপ ছিল। সেলজুকগণ এই বুভেয়হী রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে তাদেরকে বাগদাদ থেকে অপসারণ করে। সেলজুকের সুলতান তুঘরিল বেগ, আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে গেলে তৎকালীন আব্বাসী খলিফা কাইম বি আমরিল্লাহ তাকে সাদর সম্ভাষণ জানান এবং তাকে সুলতান রুকুনুদ্দীন নামক উপাধীতে ভূষিত করেন। তাকে তার নিজের আসনে বসান এবং অনেক সম্মানে ভূষিত করেন। তার নামে মুদ্রাঙ্কিত করেন এবং বাগদাদ সহ অন্যান্য অঞ্চলের মসজিদে খুতবার সময় তার নাম উল্লেখ করা হয়,, এইভাবে সেলজুকদের মান- মর্যাদা আরো বেড়ে যায়।

পরলোকগমন : সেলজুকীয় প্রথম সুলতান হিজরী ৪৫৫ সালে পবিত্র রমজান মাসের শুক্রবার রাতে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন, তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার পরে সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন তার ভাতিজা সুলতান আল্প আরসালান বেগ, সুলতান তুঘরিল বেগের মৃত্যুর পর সেলজুকগন, সুলতান আল্প আরসালানের নেতৃত্বে খোরাসান, ইরান, উত্তর – পূর্ব ইরাক অঞ্চলে পুনঃদখল করে সাম্রাজ্যকে সুসংগঠিত করেন। More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button